সম্পাদকীয়
আদিমকাল থেকেই কোনও না কোনও ব্যবস্থা মানুষকে
তার গণ্ডীর মধ্যে রাখতে চেয়েছে। পেরেছে কি? নায়গ্রা জলপ্রপাতের কাছে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে
অলটারনেটিভ কারেন্ট তৈরির কথা কল্পনা করতে পেরেছিল তাকে তার বাবা পাদ্রী হওয়ার পরামর্শ
দিয়েছিলেন। নিজের পথেই ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, পেরেছিলেন কি? পারেননি। পরবর্তীকালে
সেই ছেলেটি ওই জলপ্রপাতের ধারে মেশিন প্রতিস্থাপন করে বিদ্যুৎ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।এই
ঘটনাটি কি কবিতার চাইতে কম কিছু? মনে হয় না। তাঁকে বাংলা কবিতার মতো দাদাদের বাতলে
দেওয়া পথে হাঁটতে হয়নি। তরুণ মনের ভক্তিকে কুন্ঠিত করতে হয়নি। জায়গা খুঁজতে হয়নি। তিনি
হেঁটেছিলেন। পেরেছিলেন কল্পনার হাত ধরে বাঁচার রাস্তায় হাঁটতে। যুদ্ধের বা প্রতিযুদ্ধের
রাস্তায় নয়। কবিতা কোথায় নেই? নিজের উদ্বেলতা, আবেগ দিয়েই কবিতা লেখা যায়, কবিতা উপভোগ
করা যায়। এলিয়ট তাঁর জীবনের শেষদিকে কোনো প্রগাঢ় কবিতা লেখেননি। আসলেই তাই কি? একজন
নিকোলাস টেসলা বা একজন এলিয়ট নিজের নামের পতাকা হতে চেয়েছিলেন, নিজেকেই নিরসন করে।
কোনো নামের পতাকা বাহক হয়ে নন। আজকাল কবিতার বইয়ের চেয়ে মঞ্চের উত্তরীয়র কাটতি বেশি।
আজ বিজ্ঞান অনুভবের চেয়ে কপচানো হয় বেশি। আসুন পাঠক সমস্ত চাতুরী পেরিয়ে শীতের হাল্কা
আঁচ গায়ে মেখে পড়ে নেওয়া যাক এই কবিতাসংখ্যা। জয় হোক বাংলা কবিতার। সহজগ্রাহ্য হোক
কবিকে ছাপিয়ে কবিতা।
-
শানু
চৌধুরী
অংশুমানের দুটি কবিতা
কবিতা
নয়
২৬
ছাদে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ শিরদাঁড়ায় তেজপাতা বোলাচ্ছি
দেখে এক স্বামী-স্ত্রী ঝাপটে জানলা বন্ধ করতে গেল
পারলোনা।
ঘটনা, দৈর্ঘ্যে না ইম্প্যাক্টে বড় হয় সে নিয়ে অনেক রাজনৈতিক মতামত
আছে
তাতে কিছু যায় আসেনা
অঘটন সম্পর্কে আমার বিদগ্ধ ধারণা আছে
২৭
গিটারে একটা রিফ বানাতে গিয়ে মনে পড়লো
স্টেটমেন্টধর্মীতা নিয়ে আগেও কথা হয়েছে
আপনি বললেন, আহা!
আপনার বন্ধু বলল, বাল!
এখানেই আমি সময় আর স্মৃতির সম্পর্কে
কাবাব মে হাড্ডি
জানি, ফিফথ নোটে লিড শুরু করলে
অডিয়েন্স কেঁদে ফেলে
মাসুদার রহমানের দুটি কবিতা
ছাতিম
দড়িতে
টাঙানো জামা কাপড়ের সাথে দুপুরকে ভাঁজ করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ছাতিমগাছের
নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি তার চলে যাওয়া
ছাতিমগাছের
হাতে আমি এক ক্যানন ক্যামেরা, আমার চোখ দিয়ে ছাতিমগাছটি এই দৃশ্য দেখে নিচ্ছে
তারপর
সারাটি বিকেল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে ছাতিমের ঘন ছায়া
০৭/১১/২০১৮
খরগোশ
একটি খরগোশ
বিছানা থেকে লাফ দিয়ে চলে যাচ্ছে। উঠোন মাড়িয়ে... জোস্না মাড়িয়ে... খেত আর মাঠবাড়ি
ছেড়ে... দাঁড়িয়েছি, ধূ ধূ প্রান্তরে সাদা অনেক খরগোশ
তার মধ্য
থেকে খুঁজে আর কোনদিন পাবো না আমার বালিশ
০৫/১১/২০১৮
শানু চৌধুরীর একটি কবিতা
রাতে লেখা কবিতা
পূর্বক্ষণের থেকে
পিছিয়ে এসে দেখি আমাদের সৎকার লেখা হয়ে গেছে। পিঠে
যার শুকনো দাগ। কাঙ্ক্ষিত রাজীবে ঘষে যাওয়া, গর্ভবতী মায়ের পেটের মতন। গোড়ালি ও শঙ্খের সুষমায় জড়ানো
নাভিহারা খিদে, রঙীন
মাছের স্বভাববাহিত জলে ঠোকর দেয়। এসব চাঞ্চল্য অথবা ছায়ায় জড়ানো রূপ,
মৃত্যুগামী মানুষের আয়ু গড়ে স্যাকরার কৌশলে।
সুবর্ণ তামার ভাবনা ছেড়ে, স্রষ্টার বুকের পাঁজরে বানানো শূন্য দোলক, একেকটা জন্মের দিন অথবা শ্মশানে ফোটা ফুলের কালো কান্নার
তৎপর জলবায়ু, সদ্য
চোখফোটা বিড়ালের কলজে নিয়ে আর্তনাদ করায়। এসব ভুলে গেলে একটা কাঁচা সূর্য পালক হয়ে
ওঠে। যুবতী মায়ের জরায়ুতে জোনাকির মতো সারিবদ্ধ আলো নিয়ে। হে মৃত কোল বৃথা হলো তবে
শাবকের প্রতীক্ষা? আছড়ে পড়ো ফুল, অবৈধ হও। হাঁড়ি পুড়ে যাওয়ার সাক্ষ্য নিয়ে চৌচির হবিষ্যির করুণা উদ্বাস্তুদের মৃতরসে বেঁচে আছে নতমুখে। যাদের ফুসফুসে উল্কির মাধুরী
খোদিত, তারা জানে মানুষের সব স্পর্শের দম্ভই আত্মজীবনীতে ঘষা হয়ে আছে।
রত্নদীপা দে ঘোষের দুটি কবিতা
মাইসংক্রান্ত
১২
তাকানো এমন, যেন ভারি গ্রন্থদুটি চুষতে
শুরু করবে তৃষ্ণার টিপসি
ইলেকট্রনের রোদ বরাবর চুড়শঙ্খের উষ্ণদেশ,
যেন কোনো ব্যক্তিগত প্রোটনসঙ
তীব্র প্লাজমের প্রিন্ট যেমন বাতিদান জুড়ে স্তনফোয়ারা, উচ্ছল
মাতরমের অর্গান
ওগো গ্রন্থদুটি, মাতৃতান্ত্রিক ইমেজারি আর
নয়
একটু পরেই তো ঝরে যাবে, এখন তোমাদের উচিত একটু
বাচ্চা বাচ্চা
ব্রেসিয়ার-খোলা-চোখে-চোখে
তাকানো
১৩
মাইয়ের কন্ঠটি বেশ টিপসই মার্কা জোরালো
আমেজের সুদিং, এফেক্ট সম্পূর্ণ গোলাকার
চারপাই আলোতে হাসিটিও ছোঁয়াচে
গহ্বরের গভীরে, গুপ্তহত্যার ভ্যাকসিন বলয়ে
ডিফেন্সের নতুন পালকে এক ছটাক চপারের রেশ
একটু রূপকথা, একখণ্ড ওয়ান্স-আপন
ব্যাস, এইটুকুই মাইসাম্রাজ্যের উত্থানের কারণ
প্রশ্ন একটাই। মাই কি কখনো আগ্রাসনের ভয় পায়?
পায়। যে রাষ্ট্র যত বড় তার তত বেশি নিরাপত্তা পায়
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের দুটি কবিতা
পারিবারিক ছুটি
ফেনা শুকিয়ে অস্থি-নুন পড়ে থাকে।
নুন মিশে যায়
বালিতে
ইমারতে
ঘামে
এই অবধি শুনে, মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে
ভাবো -
ফেনা মিশে আছে এই সব কিছুতে।
ঢেউ মিশে আছে।
একটা আস্ত সমুদ্র, অথবা মহাসাগরই মিশে আছে।
মহাসংক্রমণের মাঝে আমরা হাসি,
নুনের পুতুলের মতো মহাসাগরে গলে যেতে যেতে মনে হয় -
রুম ফ্রেশনারে ঝাউবনের গন্ধ মিশে আছে।
মেনুকার্ড
পার্ক, গাছ, ছাতা, কুলফি
শ্রেণীবদ্ধ
মেনু কার্ড, রোমান্সের দুপুর
পেট চুক্তি, এক থালায় সব।
মাঝে মাঝে সে পথেই দেখি
বিকেলের রোদ্দুর।
ছেঁড়া টিকিট, আইসক্রীমের কাঠি, আধাখাওয়া
কামরাঙা
সব পড়ে আছে, একইরকম।
খায়
আজও কতজন, আমাদেরই মতো... ফেলে যায়।
সেলিব্রেশন, রেস্তোরাঁ, ক্রেডিট
কার্ড
কন্ডোমের মতো পরিত্যক্ত হ'লে -
ছাত, স্নানঘর আর স্বপ্নে
বোকার মতো চেয়ে থাকে, ঠকে যাওয়া এঁটো শালপাতা।
আমরা যেমনই থাকি,
টলমল করতে করতে সেই বিকেলের দ্বীপে
ভেসে যায় শালপাতাগুলো,
নিতান্ত অভ্যেসেই, আমরা এক গোড়ালি জলে দাঁড়াই,
দু'খানা মেনুকার্ড। তোমারটা আমার,
আর আমারটা তোমার হাতে।
মণিদীপা সেনের দুটি কবিতা
আদরকাঠ
এ এক নির্যাতক রাত। সামলে উঠতে, উঠেছে সটান ছিলা
মূলমধ্যরেখা বরাবর দক্ষিণে নেমে এলে নদীর মোচন
অনিবার্য ছিল কিন্তু ক্রমাগত
তুষারজারণ।
গিরিপুঞ্জ বেয়ে, বাইতে বাইতে নেমে আসছে
আচ্ছন্ন ঘাম
বুকের কাপড়ে তির্যক সুর্য আঁটোসাটো
অন্তর্বাসের পালিত অন্ধকার অপ্রস্তুত
চামড়ার গঠনে চোখের রূপ ঘুলিয়ে উঠছে।
বাড়ছে
উন্মেষিত কফিমগের তলদেশে চামচের বেগ।
এসো
নেমে এসো আচম্বিত রাজপথে প্রত্যক্ষ মহুল জিভ
কিনারে কিনার ঘষে
ছড়িয়ে দাও অনবহিত ঠমক
এসো
আমরা এবার শ্বেত পাইনের মাথায়
বারুদ অদলবদল করি!
শঙ্খ
নদীমুখ থুবড়ে গেছে
পাথুরিয়া জ্যোৎস্নাবুক স্নানে স্নান
স্তনীয় ঝিলিক।
উরুসঙ্গমঘাট অভ্রচিকন
গিলে নেয় বোঁটাসুদ্ধু পরাগথলি
দাঁতে দাঁত, তালুর পিঠে জিভ শুলানো
বাতাস
শিউরে ওঠে।
তেলপিছল আকাশ।
তার মুখে নেমে আসি।
নামিয়ে দিই
আমার কুম্ভের
সুপ্রাচীন বৃশ্চিক
অমিতাভ মৈত্রর দুটি কবিতা
১.
দ্বাদশ শতাব্দীতেই সাহসী হয়ে উঠেছিলাম আমি
আর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম
অপরসায়ণের সাথে আমার সম্পর্ক
একই গুহার দুটো ভালুকের মতো
অজুহাত ছাড়াই যারা পাপ করে নিজেদের নিয়ে
আর একটা হুইস্ট খেলার টেবিল রোজ রাতে সেই পাপ
মুখ কালো করে নিয়ে যায়
আর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম
অপরসায়ণের সাথে আমার সম্পর্ক
একই গুহার দুটো ভালুকের মতো
অজুহাত ছাড়াই যারা পাপ করে নিজেদের নিয়ে
আর একটা হুইস্ট খেলার টেবিল রোজ রাতে সেই পাপ
মুখ কালো করে নিয়ে যায়
২.
জন্মের মুহূর্তেই
অনন্ত কোনো ছবির নিষ্প্রভ একটা কোণে
অন্তর্ভুক্ত হয়ে
যাও তুমি
আর একজন অন্ধকে
পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে
তুমি সম্পূর্ণ করো সেই ছবি আর নিজেকে
তুমি সম্পূর্ণ করো সেই ছবি আর নিজেকে
যাতে
মৃত্যুর আগে অর্ধদেবতার মতো কেউ
তেলের বাতির পাশে
তেলের বাতির পাশে
নিঃশব্দে একদিন
চিঠি আর ছবি দিয়ে যায় তোমাকে
নীলাব্জ চক্রবর্তীর একটি কবিতা
শ্রেণী
লম্বা হতে হতে যে ছায়াগুলো
লম্বা হতে হতে যে ছায়াগুলো
গলে গেল
পরদিন জুড়ে
ভেঙে
রাখা আলো তার বিশেষ হয়
বিশেষণ
হয় একবার
অনতিক্রম্য সব সোনালী বোতাম
পর্যন্ত
ভ্রমণ ভ্রমণ করে
রুটিগাছে ফিরে
এইসব এবড়োখেবড়ো সময়
শ্রেণী হয় রোজ
স্মৃতি
করে
লক্ষ্য
করে
আয়না
থেকে খুলে খুলে
একেকটা ঋতু কীভাবে পড়ে যাচ্ছে...
উৎস রায়চৌধুরীর একটি কবিতা
শ্রমজীবি
আসক্তির লাগাম খেলছে,
দূর ঘরোয়া কোনো ধানের শিস
মাস্তুল গুটিয়ে ফকির হয়ে গেল,
সারাক্ষণের গর্ভস্থ অসুখ
হাত মেলে যে অধরা ক্ষেত্র,
তার আগাপাশতলা খুঁজেই
আমি আর এই বালক বয়স পেরোলাম না-
ভীষণ রিলিং হচ্ছে পয়েন্ট,
একশোভাগ চাওয়ার টেবিল নীল চাবুক,
ঘুরতে ঘুরতে লস গ্লোবালের পাড় ছুঁয়ে
দেনাবাহারের। পক্ষরা খুলে আছে,
আমি রোজ ভাবনার আলোকপাতে
খসখস করে মাদুর পেতে
অন্ধকার চিলতে কুষ্ঠি মেখে নিজেকেই ডাকি,
বাহক হয়ে পড়ে থাকি।
ফারাহ্ সাঈদের একটি কবিতা
ফারাহ্ সাঈদের একটি কবিতা
মালকোষ
ঘুড়ির মতো এ কোন মালকোষ
তৃতীয় প্রহরের ছাদে লাইলি গুনতে গেছে
কত যে নোনাচোখ আহা,
ভেসে ভেসে রঙের উৎসবে সমুদ্র ভিজিয়ে দেয়
বছর পেরিয়ে বনবাস, রঙের ঘুড়ি ওড়ে
এ ঠাটের অন্তর্গত শীত
নখের শেষভাগে লীলা দেখিয়ে গেলেও
উত্তরবিহীন এক চিঠি
ননসেন্স কোনো সোমবারের
ধারেকাছে সুতো
আর কাটে না
বিনায়ক দত্তের দুটি কবিতা
১.
আজ একা
তুমি কাজে
ডুবে যাওয়ার
টানটুকুও নেই যখন
পাখিদের স্বর
আলাদা থেকে আলগা হয়ে যায়
আজ একা
তুমি কাজে
ডুবে যাওয়ার
টানটুকুও নেই যখন
পাখিদের স্বর
আলাদা থেকে আলগা হয়ে যায়
২.
চিল্কিগড় গিয়েছিলাম
এখন গাছগুলোর নাম মনে পড়ছে না
অথচ আমি কিছু গাছের নাম পড়েছিলাম
জংগলের মধ্যে থাকা জন্তুগুলোকে দেখে
বলেছিলাম ওরা নরম তারজালি ভেঙে বেরিয়ে
আসছে না? সবাই বলেছিল মূরতির
আমি সবকিছু ভুলে যাচ্ছিলাম
মনে পড়ছিল না আমি কোথায় আছি
মনে পড়ছিল না আমি নেই
সেতুর উপর কয়েকটা ছবি
মনে পড়ছে
এ লেখায়
এখন নেই
চিল্কিগড় গিয়েছিলাম
এখন গাছগুলোর নাম মনে পড়ছে না
অথচ আমি কিছু গাছের নাম পড়েছিলাম
জংগলের মধ্যে থাকা জন্তুগুলোকে দেখে
বলেছিলাম ওরা নরম তারজালি ভেঙে বেরিয়ে
আসছে না? সবাই বলেছিল মূরতির
আমি সবকিছু ভুলে যাচ্ছিলাম
মনে পড়ছিল না আমি কোথায় আছি
মনে পড়ছিল না আমি নেই
সেতুর উপর কয়েকটা ছবি
মনে পড়ছে
এ লেখায়
এখন নেই
হিয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে...
ত্যামন বিকেল করে কেউ আজ ডাকে নি আমায়।
ত্যামন ঝুমুর করে কেউ আজ ডাকে নি আমায়।
তবু ত্রিনয়ন জেগে উঠেছে৷
ফুঁসলে উঠছে প্রতিসারিত ছাতিম ঘ্রাণ।
ফুঁসলে উঠছে শোণিত ও ষোলোকলা।
তোমাকে ভাবছি৷
এলোপাথারি ক্ষোভে ইরায় ফেলে যাচ্ছি যুগল দ্রাঘিমা।
আর শিহরিত শীতঘুমে কেঁপে কেঁপে উঠছি এই স্তোকে যে
সমান্তরাল কোনো এক পৃথিবীতে
তুমিও আমার কথা ভাবছো।
*
চর্যাবাহু অশেষ লুটালো।
আরক্ত পাদপদ্মে নব বিবাহের মতো রীতি এলো
নির্বাণ য্যানো।
চোয়ালে চোয়ালে এক নিভন্ত চাপা উদ্বেগ।
কোন এক অতিপ্রাকৃত প্রাঞ্জল চলন
আমাকে টুপটাপ সব
অসহনীয় সারিগান অভিমুখে নিয়ে যাচ্ছে।
বৃন্তে বৃন্তে ভেসে উঠছে আতর মিনার।
আর অসহ্য পালকে ভেসে উঠছো তুমি....
নীলাভ কৈশোর...
অক্ষৌহিণী বৎসর পূর্বের প্রেমিকের ঝাপসা মুখ...
*
নিবিড় ঝারোখার প্রসঙ্গে আসি।
প্রাকৃত কষ্টের প্রসঙ্গে আসি...নতমুখে।
নির্ঝর বাগান আর কুঞ্জ কুঞ্জ লিঙ্গের কথা বলি।
বিষন্ন চাঁদোয়ার নীচে শ্বাসরোধী রোদ।
বাগানে বাগানে বিলাপের মতো স্নিগ্ধতাপ সব আয়োজন।
জাদুবিন্দুতে ক্রমপ্রসারী রক্তের ঝনঝন শব্দ।
অথচ তুমি নেই।
অথচ তোমার শীর্ণ মধ্যমা আমায় ছুঁয়ে নেই।
এই ভেবে বকুলের মতো আস্বস্ত হই।
বাসরের মতো বিদীর্ণ ৷
দূরে কোথাও মাদলের মাস ছড়ায়।
আর পর্দার আড়াল থেকে এসব ত্রিকোণ দেখে
তুমিও হেসে ফ্যালো…
অবিকল অবিকল পালতোলা নুপূরের মতো।
*
প্রণালী চিনিনি আমি।
বনাণীর পথও চিনিনি।
মাইলফলক হয়ে গেঁথে থাকতে চেয়েছি শুধু
তোমার যাতায়াতের উপপ্রান্তে।
রতি ও রজক আমি কখনো চিনি নি।
শিমূল শিমূল হয়ে একে একে নিভে গ্যাছে
পথঘাট, গ্রাম, উপত্যকা...।
অনিবার্য যাতায়াত নিভে গ্যাছে।
শুধু মাঝে মাঝে, দু একটি দুর্বিনীত শিখার মতো
আয়নায় তোমার ছায়া।
শুধু মাঝে মাঝে, দু একটি প্রথাগত হত্যার মতো
পল্লবে তোমার মুখ।
*
তাহার বৃষ্টির আমি নাম দিয়েছি উপশম।
তাহার ক্রোধের আমি নাম দিয়েছি মল্লার।
গতরে গতরে সেও কত বিভা ছড়ালো।
বিন্যাসে বিন্যাসে মুখরিত কোয়েল স্বভাবে
সেও কত চার্বাক হল।
এই দ্যাখো তোমার বিহনে
ফুলতোলা নক্সায় তাকে আমি পরব মেনেছি।
তাকে আমি আতপ মেনেছি।
অকস্মাৎ ফিরে এলে দেখে নিও
আমাদের অনাগত ধুকপুক
কোনরূপ ডাগর হয়েছে।
*
মেঘান্ত নেমে আসে মৃত্যুপম হাওয়ার মতোন।
হাঘর ক্লান্তি আসে আলোকিত তর্জনী হয়ে।
কামরূপ উন্মোচিত হয় য্যানো প্রখর বিষাদ।
আলজিভ জ্বলে ওঠে শাক্ত কিশোরীর মতো দ্রোহে।
এতদসত্ত্বেও তুমি নির্বিকার ঋতুর মতোন।
এতদসত্ত্বেও তুমি দূরাগত নিঁখুত বাঁশরী।
উজান উজান ঘ্রাণে প্রবল হয়েছো অনীহায়।
আমাকে ক্ষুধার্ত রেখে চলে গ্যাছো নাবিক স্বভাবে।
*
শালপ্রাংসু সন্দেহের মতো গহীন তোমার উপাচার৷
তালুবন্দী মুহূর্তকথার মতো স্বাদু তোমার বিরহ।
ওগো নিঠুর রন্ধনপ্রণালী আমায় বারুদের মুখে নিয়ে চলো ৷
বিস্ফোরণের আগে ও পরে
যাবতীয় মায়াতাঁতে নিঝুম পর্দা সাজাই৷
আলোকিত দোয়েল সাজাই৷
তরল আগুনে দ্যাখো তোমাকে ধারণ করেছি৷
তোমাকে ললাটে বুনেছি৷
আর প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় অবিকল ঈশ্বরী হয়ে উঠেছি ...
তোমার দেহজ ঈশ্বরী৷
*
তোমার শ্বাসের কাছে নাভি মেলে দিই।
তোমার ফলের কাছে কন্ঠা ও কষ্টকর ত্রিতাল মেলে দিই।
শরীর শরীর শুধু চরাচরবিস্তৃত আতুর শরীর।
সুরভি সুরভি শুধু কর্ণমূল বিস্তৃত পিদিম সুরভি।
কাবিনস্বভাবে আসি।
কথা বলি নীচু ও আলোকিত স্বরে।
আমাকে শস্যে ডাকো।
হংসধ্বনিতেও ডাকো।
এই যে আঁচল মেলেছি,
দুই বুক মেলে দিয়েছি পুতনার মতো।
এসো এসো, কলরোল করো।
এসো এসো,
ঋতুময় হয়ে এসে ছারখার করো।
*
ধীরে রজনী আরো ধীরে...
শুধুমাত্র এই স্তবে সন্ধ্যে নামলো।
মৌতাত যোজন নামলো।
ধনুর্ভঙ্গের মতো রাগ নিয়ে তুমি দৃষ্টি মেললে।
মাধুকরীর মতো হিংসে নিয়ে তুমি সংহার শানালে।
এখন আমি আর কোনরূপ জোৎস্নাগন্ধ প্রস্তাব করি!
ছিন্নভিন্ন গর্ভ নিয়ে এই উপদ্রুত অঞ্চলে আমি এসেছি।
স্বাতী ও শর্বরী আমি শরীরে নিয়েছি।
দ্রবনীয় হলাহল বৃন্তে নিয়েছি শুধু
তুমি বিন্দুবিৎ ছুঁয়ে দেখবে বলেই।
অসিচালনার মতো দৃপ্ত একটি পরিপূর্ণ মৃত্যু ছাড়া...
বলো বলো আর কীভাবেই বা
দ্যাখা হতে পারতো আমাদের?
*
আঙুল জ্বলেছে মশগুল।
বিপদসীমার ন্যায় জঙ্ঘা জ্বলেছে।
নাভিকুন্ডে পদাবলী হা হা রূপে ডালিম হয়েছে।
রোমকূপে রোমকূপে শিউলির ঘ্রাণ ধরে রুদ্র এসেছেন।
ভস্ম মেখেছি আমি।
জলপথে পুড়ে গিয়ে মালকোষ মেখেছি।
সংগম পাই নি তবু নিজদোষে পাবক হয়েছি।
শুধু তুমি, একটিবার, অন্তত
একটিবার
শাফিন সাজাবে সে কারণে।
শুধু তুমি, শেষবার,
গণিকা বিষাদ মেপে আঘাত করবে সে কারণে।
*
বিবাহ চাও নি তুমি।
রাধিকা চেয়েছো।
অন্ত্যজ সমর্পণ, আকুল বেহাগধ্বনি সপাটে
চেয়েছো।
আমিও দিয়েছি ঠিক যতটুকু সামর্থ্য আমার।
শীতাতপ দিয়েছি।
সৌপ্তিক বাসর দিয়েছি।
বিঘত দূরত্বে থেকে কৃষ্ণরূপ আকুলিবিকুলি দিয়েছি।
তোমার জন্মতিলে প্রবেশ পাই নি তবু হৈ হৈ চরস দিয়েছি।
সতীচিহ্ন দেখে তুমি বিরক্ত হয়েছো
তবু মার্জনা দিয়েছি।
সেসব প্রণামী তুমি অহঙ্কারে স্বীকার করেছো।
আমাকে স্বীকার করো নি।
আর প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় গাঢ় লাল দ্বাপর হয়েছো।
বিনিময়ে সন্তান কখনো দেবে না তুমি জানি।
প্রত্যাখ্যানটুকু শুধু দিও...
আর কী বা চাইতে পারি বলো?
*
আর কখনোই তবে দ্যাখা হবে না..
এমতো ভেবে আমি সীমান্তে পৌছেছি।
শরীরের নিবিড়তম শেষে পৌছেছি।
তুমিগন্ধে আচ্ছাদিত সে এক প্রোজ্জ্বল সরণী।
নিস্ফলা তনুবৃক্ষময় সে এক আশ্চর্য নদ।
আমাদের অধরা মিলন সেখানে অভ্রান্ত উপগ্রহ হয়ে
বিষুব ছায়ার মতো উপশম দেয়।
জলপট্টি দেয়।
সেই ছায়াস্নাত হয়ে, দেখে যাও আমিও কীরূপে
জঙ্ঘাবতী হয়েছি।
অপরূপ জাজিম হয়েছি।
অসহ্য রতির কাছে নতজানু হয়ে যথাযথ গর্ভিনী হয়েছি।
দেশ রাগ জ্বলে উঠছে।
সার্বিক যাপন জ্বলে উঠছে।
আর তোমার অবিসংবাদী বিরহ উপড়ে
আমি অবশেষে নিশ্চিন্ত হয়েছি...
তুমিময় এ প্রদেশে কোত্থাও কোত্থাও তুমি নেই।
কখনো ছিলে না।
*
তাহার নাভির কাছে বোষ্টমী এসেছে।
তাহার উল্কির কাছে ভ্রমময় ব্রজবুলী এসেছে।
আমাদের ক্ষীণ যোগাযোগ বরাবর রেখাপথে
সে একা অপেক্ষা করে এলোচুলে,
কবেকার ডাকিনী য্যানো।
আহা তাকে আঘাত কোরো না।
জরায়ুর মতো তার ললাট চুম্বন করো,
প্রথমবারের সেই অপাপবিদ্ধ চুম্বনের মতো।
এসো তবে, নিজ নিজ উপাচারে ব্রতী হই।
নিজ নিজ কামাখ্যা সাজাই।
শুধু সেই ধূমায়িত স্নেহের উদরে,
তুষময় পাঁচালীর মতো,
আমাদের কখনো না জন্মানো কন্যাটি বেঁচে বর্তে থাক।
আমাদের কখনো না জন্মানো কন্যাটি সংসার পাক।